পদ্মা চরের পরিযায়ী পেঁচা
আমাদের দেশের একমাত্র পরিযায়ী প্যাঁচার নাম ছোটকান প্যাঁচা। অন্য সব প্যাঁচার চেয়ে আলাদা স্বভাবের পাখি এটি। দেখা যায় মূলত শুষ্ক মৌসুমে। নদীর চর ও উপকূলে এদের বিচরণ বেশি। বিরল এ প্যাঁচা দেখার ইচ্ছা সব সময়ই আমার থাকে। পদ্মায় পাখি দেখতে গেলেই আলাদা করে এই প্যাঁচাকে খুঁজি। প্রথম এর দেখা পেয়েছিলাম গাইবান্ধার বালাসিঘাট থেকে বুলবুলিচর যাওয়ার পথে। সময়টা ছিল প্রায় এক দশক আগে। এরপর আরও বেশ কয়েকবার প্যাঁচাটির দেখা পেয়েছি পদ্মার চরে। কিন্তু আমাদের কখনোই জানা ছিল না এই প্যাঁচা নদীর চরে কত সংখ্যায় টিকে আছে।
কয়েক বছর ধরে রাজশাহীর পাখিপ্রেমীরা পদ্মার চরে এই প্যাঁচার নিয়মিতই খোঁজখবর রাখছেন। এ বছরও বেশ ভালো সংখ্যায় দেখা গেছে। পাখি আলোকচিত্রী মো. ইমরুল কায়েস চাঁপাইনবাবগঞ্জের বাকরআলী এলাকার পদ্মার চরে গত ফেব্রুয়ারি মাসে আটটি প্যাঁচা দেখেছেন। পরের সপ্তাহে চর খিদিরপুর অঞ্চলে আরও তিনটি প্যাঁচা দেখার তথ্য দেন তিনি। এ তথ্য জানান দিচ্ছে, পুরো পদ্মা-যমুনার চরাঞ্চলে এ প্যাঁচা বেশ ভালো সংখ্যায় টিকে আছে। চরের ঘাসবনই এর টিকে থাকার প্রধান কারণ। এই ঘাসবনের ভেতর ইঁদুরসহ ছোট ছোট স্তন্যপায়ী ও পোকামাকড়ের বসবাস। এসবই প্যাঁচাটির প্রধান খাবার।
তিন শ গ্রাম ওজনের এই প্যাঁচা আমাদের দেশে আসে শীতে। বর্ষায় নদীর চরগুলো ডুবে গেলে প্রজননকাল কাটানোর জন্য চলে যায় উত্তর ও মধ্য এশিয়ার দেশগুলোতে। অস্ট্রেলিয়া আর অ্যান্টার্কটিকা মহাদেশ ছাড়া পৃথিবীর সব মহাদেশেই এদের উপস্থিতি। পরিযায়ন করে এক দেশ থেকে অন্য দেশে। এমনকি এক মহাদেশ থেকে অন্য মহাদেশেও পাড়ি জমায়।
বাংলাদেশের ১৬ প্রজাতির প্যাঁচার মধ্যে এই ছোটকান প্যাঁচাই একমাত্র পরিযায়ী। এটি উপকারী প্যাঁচা। স্বভাবেও একদম ব্যতিক্রম। অন্য সব প্যাঁচা নিশাচর হলেও এই প্যাঁচা দিনের বেলা খাবার সংগ্রহ করে। এরিক লুটভেনসেন নামের এক ড্যানিশ পাখিবিশারদ প্যাঁচাটির এ রকম অদ্ভুত স্বভাবের কথা উল্লেখ করেন ১৭৬৩ সালে।
আকারে স্ত্রী প্যাঁচাটি পুরুষটির চেয়ে বেশ বড়। প্যাঁচাটির সমতল মুখ, টানা টানা চোখ আর গোলাকার মাথা দেখলে মনে হবে মানুষের প্রতিচ্ছবি। এ জাতের প্যাঁচা মাটিতে ঝোপঝাড়ের মধ্যে বাসা বানায়। অদ্ভুত ব্যাপার হলো, স্ত্রী পাখিটি একাই ডিমে তা দেয়। এ সময় পুরুষটি স্ত্রীটিকে খাবার সরবরাহ করে। বাচ্চা একটু বড় হলে একই মৌসুমে খাবারের সহজলভ্যতা থাকলে আবার ডিম পাড়ার চেষ্টা করে। ব্রিটিশ এক গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, প্যাঁচাটি ১৩ বছর পর্যন্ত বেঁচে থাকে।
ছোটকান প্যাঁচাটি লোকালয়ের পাখি নয়। তাই সাধারণ মানুষ এই পাখির দেখা পায় না। কিন্তু নিভৃতে এই পাখি কৃষকদের কতটা উপকার করে, তা আমাদের ধারণা নেই! এই প্রজাতির প্যাঁচা আমাদের চরাঞ্চলে বছরে প্রায় দুই শ দিন কাটায়। প্রতিদিন যদি তারা একটি করে ইঁদুরও ধরে খায়, তাহলে একটি প্যাঁচা ফসল রক্ষায় কতটা অবদান রাখছে, তা সহজেই অনুমান করা যায়।
আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে প্যাঁচা সংরক্ষণের জন্য আলাদা উদ্যোগ নেওয়া বেশ কঠিন। কিন্তু চরাঞ্চলের এই ঘাসবনগুলো রক্ষার কথা অবশ্যই বলা যায়। প্যাঁচা ছাড়া আরও প্রায় দুই শ প্রজাতির পাখির উপযোগী আবাসস্থল এই ঘাসবন। প্রায় সবই পরিযায়ী পাখি। চরের এসব ঘাসবন প্রতিবছরই কমে যাচ্ছে। আর পাখিরা হারাচ্ছে তাদের প্রিয় আবাসভূমি। এভাবে চলতে থাকলে উত্তরাঞ্চলের কৃষকদের ফসলের খেতে কীটনাশকের প্রয়োগ আরও বাড়াতে হবে, এটা নিশ্চিত
ধন্যবাদ আল্লাহ হাফেজ